মাছ ধরা পড়লেই একসঙ্গে সবাই আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠতেন


আব্দুল মালেক: হায় চিল, সোনালী ডানার চিল/এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে।জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল এখন আর ধানসিঁড়ি নদীর তীরে কাঁদতে দেখা যায় না। ধানসিঁড়ির মত নদীগুলো এখন গেছে শুকিয়ে। চিল আর খুঁজে পাওয়া যায় না গ্রামবাংলায়
ধলেশ্বরী, হাজিুপুর, চন্দ্রখালী ও সাটুরিয়ার বিভিন্ন বিলঝিলে  এক সময়ে এলাকার মুরুব্বীদের ও জোয়ানদের দলবেধে বড়ফাসে বোনা লম্বা
জালে বা পলো নিয়ে
 মাছ ধরার
জন্য যেতো এ শৌশুমে।
আর আমেজ নিয়ে হাকঢাক পিটিয়ে দল বেধে সবাই বের হয়ে
যেতাম মাছ শিকারে। অনেক আনন্দ উৎসব হত সেকালের এ দলবদ্ধ মাছ শিকারে। সকালে
মাছ শিকার করতে গিয়ে অনেক সময় সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

অনেক মজা করে গান গাইতে গাইতে চলতাম মাছ ধরতেবাবা মাকে খুশি করার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা পরিশ্রম করতাম মাছ ধরতে বিভিন্ন ডোবানালায় বাচ্চাদের গামছা দিয়ে মাছ ধরারদৃশ্য চোখে পরত।
জাল ফেলে বা বরশি দিয়ে মাছ মারার দৃশ্য কার না ভালো লাগে শুকনো মওসুমে যখন খালবিলের পানি শুকিয়ে যেতে থাকে তখন সেখানে নেমে ছোটবড় অনেককেই মাছ ধরতে দেখা যেত এমন সময় অন্যান্য সময়ের চেয়ে মাছ একটু বেশিই পাওয়া যেত কারণ সব মাছ একসাথে ধরা পড়ে সেখানে পলো, বাওয়া ইত্যাদি দিয়ে খালবিল, নদীনালায় মাছ শিকারের ধুম লেগে
যেত
প্রায় শুকনো জলাশয়ে প্রতিদিনই হাজার হাজার ছোটবড় মানুষ পলো, বাওয়া, উচা ইত্যাদি দিয়ে এমনকি খালি হাতেও মাছ ধরার দৃশ্য যতেষ্ট চোখে পড়তো এটা যেন পরিণত হতো গ্রামীণ উৎসবে
 
মৌশুম আসার আগে থেকেই মানুষ এভাবে মাছ ধরার জন্য নানা প্রস্তুতি নিতে থাকতো বেশ কয়েকদিন ধরেই  গ্রামবাসীরা দলে দলে  বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মাছ শিকারে কাটাতো ব্যস্ত সময়  দশ গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, মজুরসহ অন্যান্য শ্রেণীপেশার মানুষও শখের বশে হলেও পলো, বাওয়া ইত্যাদি নিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরতো
 
কালের সাক্ষী বহনকারী সটুরিয়া
উপজেলার ঐতিহ্যময়
ধলেশ্বরী নামক নদীটি মাছ শিকারের জন্য বিশিষভাবে খ্যাত প্রায় শত বছর ধরেই এমন সময় আশপাশের গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরতে
আসতো এখানে
  কারো  জাল, পলো, বাওয়া ইত্যাদিতে রুইকাতলা, বোয়াল, শোল ইত্যাদি মাছ ধরা পড়লেই একসঙ্গে সবাই আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠতেন তখন তাদের মনে আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায় আনন্দের ঢেউ তাদের এই আনন্দউৎসব দেখা বা উপভোগ করার জন্য দূরদূরান্ত থেকেও আসত অনেক লোকজন এতে শিশুকিশোররা খুব বেশি আনন্দ পেত 
 মাছ ধরে তা অনেকে বাজারে বিক্রি করতো আবার অনেকে এই মাছ আত্মীয়স্বজন নিয়ে মিলেমিশে খাওয়ার
জন্য স্থানীয় ভাষায় ডালা স্বরুপ দিত
এতেও তারা আরো বেশি আনন্দ পেত মাছ ধরার সময় নানা ধরনের গানও তারা সুর করে গাইত এই আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠতো এলাকার আশপাশের গ্রামগুলোও তাদের দেখাদেখি অন্যান্য স্থানের লোকেরাও এমন আনন্দে কমবেশি মেতে ওঠত অনেকে এমন দিনগুলোর জন্য অধির আগ্রহেও অপেক্ষা
করতো
আজ সেসব শুধুই স্মৃতি সেসব কথা মনে করতেই চোখে জল এসে যায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সে স্মৃতিময় দিনগুলোতে
গ্রামীণ সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায়, তা হয়তো  এখন আর চোখে পরেনা। অনেক আনন্দ করেছি সেসময়েতবে এটাও ঠিক যে, গ্রামবাংলার ধরনের দৃশ্য আনন্দ ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে এর অন্যতম কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি দিন বদলের পালায় বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই সর্বগ্রাসী বিশ্বায়নের এই যুগে বদলে যাচ্ছে মানুষের রুচি, অভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ, আচারআচরণ, সাংস্কৃতিক সামাজিক কর্মকাণ্ড, পেশাসহ অনেক কিছুই যুগের ব্যবধানে গ্রাম পর্যায়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে
এখন আর ঘরের চালে লাউকুমড়োর সবুজ লতানো গাছপালা শোভা পায় না কোনো গ্রামে ছায়াঘেরা মাটির দেয়াল তোলা ছনের ঘর চোখে পড়ে না গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষালাভের আগ্রহ বাড়ছে এবং তারা শিক্ষিত হচ্ছে এভাবে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা পরিবর্তন ধারা অব্যাহত আছে তা ছাড়া আগের মত দেশী মাছ আর এখন চোখে পরেনা। এর
প্রধান কারণ-জলবায়ুর
বিরূপ প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদনদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খালবিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবানালা পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের অবাধ চাষ মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো
 
তারপরও ভাল যে মাঝে মাঝে দুর দুরান্তের কোন কোন বিলেঝিলে এখনো অনেক স্থানে দেখা যায় মাছ ধরার উৎসব ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে বলে ধরনের অনেক সংস্কৃতিও এখন আর আগের মত চোখে পড়ে না অথচ এসব সংস্কৃতি গ্রামবাংলার মানুষের বিনোদনের মাধ্যমও বটে এসব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধরে রাখতে হলে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে
লেখক:  আব্দুল মালেক,
সচিব বরাইদ ইউনিয়ন পরিষদ, সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ।
মানিকগঞ্জ২৪/ ২৩ সেপ্টেম্বর/
২০১৭।
আরো পড়ুুন